সেই সাথে তারা আগামী বছরের শুরুতেও যদি একটি কার্যকর ভ্যাকসিন অনুমোদন পায়, তবুও বাংলাদেশ প্রাথমিক পর্যায়ে এটি পেতে সক্ষম হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ ভ্যাকসিন পেতে মূলত আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট- গ্যাভি’র (দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস) ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা পরিচালনা করছে এমন সব সম্ভাব্য দেশ এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি দেশে একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ দরকার যাতে ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদনের পর তার একটি দেশেও উৎপাদন করার অনুমতি পাওয়া যায়।
তারা আরও মনে করছেন, আলোচনার বিকল্প হিসেবে চীন, ভারত এবং অন্যান্য দেশের করোনা ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালেও বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে কম দামেই তা পাওয়া যায়।
এদিকে, বৃহস্পতিবার চীনা কোম্পানি সায়নোভ্যাক তাদের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ট্রায়াল বাংলাদেশে পরিচালনার অনুমতি পেয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, এ পরীক্ষায় অংশ নিলে বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের এক লাখ ডোজ বিনামূল্যে পাবে।
তিনি বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে ভারতসহ অন্য কোনো দেশ আগ্রহ দেখালে সরকার তার কার্যকারিতা যাচাই করে অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক থাকবে। চীনা কোম্পানি সায়নোভ্যাক দেশে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশ নিতে আইসিডিডিআর,বি-এর মাধ্যমে যে আবেদন করেছিল সেটির কার্যকারিতা নিয়ে সরকারের নানাবিধ বিশ্লেষণ শেষে ওই কোম্পানিকে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।’
এর আগে মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কাজ করা সব সরকারি সংস্থা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেশে আনার জন্যও কাজ করছে।
‘যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অন্য বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিন তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভ্যাকসিনগুলোর গুণাবলী যাচাই সম্পন্ন হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন,’ যোগ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
বিশ্বের ২০০টিরও বেশি সংস্থা এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কাজ করে চলেছে। মস্কোর গামালেয়া ইনস্টিটিউট কর্তৃক তৈরি করা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক’ ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের সায়নোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠান মানবদেহে তাদের সম্ভাব্য ভ্যাকসিনগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করছে।
এর মধ্যে একটি বা দুটি কার্যকর ভ্যাকসিন এ বছরের শেষ নাগাদ পাওয়া যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে ডব্লিউএইচও।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং শীর্ষস্থানীয় উৎপাদকদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তারা সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
‘সরকার বলছে যে তারা এ বিষয়ে কাজ করছে, কিন্তু এমন কোনো প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। আমি মনে করি, আমরা ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছি,’ বলেন তিনি।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, সরকারের উচিত যেকোনো উৎপাদকের কাছ থেকে সরাসরি এ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা বা দেশে এটি উৎপাদন করার অনুমতি পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করা।
‘আমরা যদি কোনো দেশ বা সংস্থাকে বাংলাদেশের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে তাদের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য রাজি করাতে পারি, তাহলে এটি আমাদের মানুষদের জন্য কম দামে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে,’ যোগ করেন তিনি।
তার মতে, এছাড়া বাংলাদশের উচিত চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেয়া।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব সহকারে দেখছে বলে মনে হচ্ছে না।
অকার্যকর এবং অপ্রতিশ্রুত ভ্যাকসিনের জন্য যেন অর্থ ও শক্তি অপচয় না হয় সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, আগামী বছরের শুরুর দিকে যদি ভ্যাকসিন পাওয়া যায় তাহলে সরকারের উচিত এখনই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ, উৎপাদন এবং বিতরণের জন্য কিছু প্রস্তুতি নেয়া।
‘আমরা কীভাবে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ বা উৎপাদন করব তার প্রস্তুতি নেয়া উচিত এবং কে এটিতে অগ্রাধিকার পাবে সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত,’ বলেন তিনি।
ডব্লিউএইচও’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, যেকোনো ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে গবেষণা, পরীক্ষা বা অংশগ্রহণ ও উৎপাদন- এ তিনটি পর্যায় রয়েছে এবং বাংলাদেশ এর সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের কোনো গবেষণা নেই। দেশে একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, আধুনিক পরীক্ষাগার এবং মানবসম্পদের অভাব রয়েছে।’
দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ এখনও কোনো ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশ নেয়নি বা কোনো দেশের সাথে কোনো চুক্তিও করেনি, বলেন অধ্যাপক মুজাহেরুল।
চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য পৃথক পৃথক পদ্ধতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত। তবে এখনও আমরা এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টা দেখিনি।’
ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশ কেবল গ্যাভি বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করছে জানিয়ে অধ্যাপক হক আরও বলেন, ‘গ্যাভি বা অন্য দাতাদের মাধ্যমে দেশের এত বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের ডোজ নেয়া সহজ হবে না। যদি প্রতিটি ব্যক্তির জন্য দুই ডোজ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হয়, তবে আমাদের দেশে কমপক্ষে ২৪ কোটি ডোজ প্রয়োজন যা গ্যাভির পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব নয়।’
তবে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে সেই ভ্যাকসিন তৈরি বা উৎপাদন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি পেতে আমাদের সম্ভাব্য সংস্থা এবং দেশগুলোর সাথে চুক্তি করা প্রয়োজন।’
অধ্যাপক হক বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের দেশে ভ্যাকসিন তৈরির অনুমতি পাওয়ার জন্য আরও অনেক দেশের সাথে তারা চুক্তি করেছে। আমরা এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়াকে অনুসরণ করতে পারি। অন্ততপক্ষে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সম্ভাব্য দেশগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ করা এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের পর ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখানো উচিত। সেটি করতে পারলে আমরা ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাব।’